মণিরামপুর উপজেলার ভূ-প্রকৃতি ও ভৌগলিক অবস্থান এই উপজেলার মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতি গঠনে ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে অবস্থিত এই উপজেলার ভাষার মূল বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশের অন্যান্য উপজেলার মতই, তবুও কিছুটা বৈচিত্র্য খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন কথ্য ভাষায় আকারের বিকৃতি এবং মহা প্রাণ ধ্বনি অনেকাংশে অনুপস্থিত, অর্থাৎ ভাষা সহজী করণের প্রবণতা রয়েছে।হিন্দু অধ্যুষিত এ এলাকার মানুষের আচার-আচরণ, খাদ্যাভ্যাস, ভাষা, সংস্কৃতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে।এই এলাকার ইতিহাস পর্যালোচনায় সভ্যতার তেমন কোন নিদর্শন পাওয়া যায় না। তবে ইংরেজ আমলের কয়েকটি নীল কুঠির ধ্বংসাবেশেষ এবং দমদম পীরের ডিবি নামক একটি নিদর্শন পাওয়া যায়। তবে বিস্তারিত কিছু জানা যায় না।। এ এলাকায় রাজবংশী এবং মুণ্ডা ক্ষুদ্র জাতিসত্বা বসবাস করে কিন্তু তাদের কোন নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি নেই । জারী গানের সাধক আব্দুল কুদ্দুস বয়াতী সমাধীক পরিচিত একটি নাম।
মানুষ ও প্রকৃতির আলিঙ্গনে সৃষ্টি হয় শিল্প। অর্থাৎ মানুষ-মাটির নিবিড় সংমিশ্রণে লোক-সংস্কৃতির নির্যাসই আমাদের প্রকৃত শিল্প। আর ঐতিহ্যই লোকসংস্কৃতির মৌলিক
প্রবাহ। লোকঐতিহ্য ছাড়া কোন দেশেই লোকসংস্কৃতির বিকাশ ঘটতে পারে না। দেশীয় সংস্কৃতি একটি দে
শের সামগ্রিক জীবন চর্চার প্রতিচ্ছবি। জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য, মানুষের জীবন ধারা, তাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি, দর্শন, ধ্যান-ধারণা, তাদের সুখ-দুঃখ, আশা আকাঙ্খা, মন-মানসিকতা-এক কথায় সমগ্র সমাজ জীবনের চেহারা সংস্কৃতি পরিশুদ্ধ আয়নায় প্রতিফলিত হয়ে ওঠে।
প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের সংস্কৃতি কালের বিবর্তনে রূপান্তরিত হতে হতে আজকের এই সভ্যতার সবুজ পৃষ্ঠা। এই বিশ্বায়নের যুগে বসে এই মূহুর্তে আমি চলে যাবো প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে ধীরে ধীরে উঠে আসা ছোট্ট একটি অঞ্চলের শিল্প-সংস্কৃতি, লোকজ ঐতিহ্যেমাখা শিল্প ভাবনার সংগ
ঠিত অবয়বে। মণিরামপুর- ঠিক আমাদের মণিকোঠায় দৃশ্যমান একটি রূপকথার গল্প। বিগত পনের’শ বছর ধরে এ অঞ্চলের লোকঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভাষা-রূপ আদি ধর্মের বিবর্তনে মানব প্রকৃতির বৈচিত্রে সৃষ্টি হয়েছে নানান লোককাহিনী, লোকভাষাতত্ত্ব, ধর্মতত্ত্ব ও লোকসমাজতত্ত্ব। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর মাঝামাঝি গ্রিক পরিব্রাজক মেগাস্থিনিস এর বিবরণে গ্রিক প্রতœতাত্ত্বিক পেরিপ্লাস, কার্টিয়াস, প্লিনি ৮০ খ্রিষ্টাব্দে তাদের রচনায় উল্লেখ করেন-বঙ্গ দেশের অধিকাংশ অংশই খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে ‘গঙ্গারিদা’ নামে সুপরিচিত ছিল। মূলত ভারতীয় উপমহাদেশের এই অঞ্চলটাই অর্থাৎ হুগলী থেকে পদ্মা পর্যন্ত ‘গঙ্গারিদা’ই ছিল। ভূ-তাত্ত্বিক ও নৃতাত্ত্বিক গবেষণায় তৃতীয় হিমবাহের সময়ে অর্থাৎ শেষ প্লাইস্টোসিন যুগ থেকে বর্তমান বাংলাদেশের উৎপত্তি। যা বঙ্গোপসাগরের প্রবাহে তীরবর্তী শিল্প-সংস্কৃতির আদিরূপে মণিরামপুরসহ এর চতুর্পাশের লোকসংস্কৃতি গড়ে ওঠে। যার প্রমাণ মেলে দোনার অঞ্চলের জমজম পীরের ডিবি নামে পরিচিত স্থানের সতেরশো বছর পূর্বের প্রত্মতাত্ত্বিক নিদর্শন। কালের ক্রমধারায় ….. বর্গ-মাইলের মণিরামপুরের ভাষা, আচার-ব্যবহারের বৈচিত্রতা লক্ষনীয়। এখানে কোলকাতা, আসাম, ত্রিপুরা, নাগপুর, বার্মা ও ইংরেজ শাসনামলের পরিত্যক্ত ভাষা মানুষের ব্যবহারিক জীবন ও সংস্কৃতিতে প্রভাব ফেলেছে। ফলে লোকসংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ মণিরামপুরের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকজ ছড়া, প্রবাদ, প্রবচন, লোকগাঁথা, লোকউৎসব সে সময়ের ও অঞ্চলের লোকদর্শন ফুটে ওঠে। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে মণিরামপুরের মজগুন্নি অঞ্চলের একটি লোকজ ছড়া যেমন-‘ডুমর গাছে কুমোর নাচে/ পায়ে ঝুম্ ঝুম বাজনা বাজে/মামী আমার নায়তে নেমেছে/ মামা একখান ঢিল ছুড়েছে/মামী কান্দে উঠেছে/ মামা মিষ্টি আনেছে/ মামী ঘরে বয়েছে/ দুইজনে চুমো খাইয়েছে।’ আবার কোদালপাড়া, বাগডোব, রহিতা অঞ্চলের ঐ সময়ের লোকজ ছড়া-‘বাক বাকুম পায়রা ডাকে উঠোন বাড়িতে/লাল পুতুলের বিয়ে হবে হলুদ শাড়িতে/ কাদা-মাটি, ধুলো-বালি মাখি, সেই খুশিতে/ সাদা পায়রা উড়ে গেল টিনের চালেতে/ মোড়লের বড় মইয়ে আঞ্জুর হাসিতে।’
মণিরামপুরের পূর্ব দিকের অঞ্চল মশিয়াহাটি, নেহালপুর, বাজিতপুর, চাপাকোণা অঞ্চলের উনিশ শতকের আগের একটি লোকজ ছড়া-‘নাচতো সিতারাম কাঁকাল বাঁকিয়ে/ শূলে চড়ে মদ্দেরাম কীর্ত্তন হাকিয়ে/ এপার গঙ্গা, ওপার গঙ্গা মধ্যিখানে চর/ তারি মধ্যি বসে আছে শিব সওদাগর/ শিব গেল শ্বশুর বাড়ি বসতি দেলে পিড়ে/ জলপান করতে দেলে শালি ধানের চিড়ে/ শালি ধানের চিড়ে নয়রে বিন্নিধানের খই/ মোটা মোটা সবরি কলা কাগমারে দই।’ এসব লোকজ ছড়ায় উঠে আসে মণিরামপুর অঞ্চলের আদি ভাষার রূপ, বৈচিত্র ও তৎকালীন সমাজদর্শন। যেমন আঠার শতকের গোড়ার দিকে শ্রীপুর, ভ্রমরদাহ, সুবোলকাটি অঞ্চলের ১টি লোকজ ছড়া এখনও বেশ জনপ্রিয়। যেমন-ওয়ান-টু-থ্রি/পালাম এট্টা বিড়ি/ বিড়িতি নেই আগুন/ পালাম এট্টা বাগুন/ বাগুনি নেই বিচি/ পালাম এট্টা কাচি/ কাচিতি নেই ধার/ পালাম এট্টা হার/ হারে নেই লকেট/ পালাম এট্টা পকেট/ পকেটে নাই টাকা/ চলে গেলাম ঢাকা/ ঢাকায় নাই বাড়ী/ চলে আসলাম বাড়ী/ বাড়ী নেই ভাত/ দিলাম এক পাদ/ পাদে নেই গন্ধ/ হাই স্কুল বন্ধ/ হাই স্কুলে যাবো না/ বেতের বাড়ি খাব না/ ব্যাত গেল ভাঙ্গে/ মাষ্টের গেল কান্দে।’ এই ছড়ায় তৎকালীন সমাজ বাস্তবতার চিত্র স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। আবার মণিরামপুরের বিনোদকাটি, কোলা, ষোলখাদা, মল্লিকপুর অঞ্চলের ছড়াগুলো একটু ভিন্নতর। যেমন- ‘কদমের ফুল মুটা মুটা/ রক্ত পড়ে ফুটা ফুটা / আছিয়ারে মারিলাম/ চুরিও ভাঙ্গিলাম/ ও চুরি নেব না/ বাপের বাড়ী যাবো না/ বাপ দেলে ইন্ডিয়ান শাড়ী/ পরে বেড়ালাম বাড়ী বাড়ী/ ইলিশ মাছের তিরিশ কাটা/ বুয়াল মাছের দাড়ি/ মান্দার গাছের উঠে দেহ গান্দির মার বাড়ী/ গান্দির মা মুরগী-চোর/ বেড়া ভাঁঙ্গে দে দোড়।’ চাঁদপুর, মাঝেলী, গরীবপুর, হেলাঞ্চি, কৃষ্ণবাটি গ্রামের একটি প্রচলিত লোকজ ছড়া-‘আয় আয় ছলে হাঁস/ তৈ তৈ তৈ/ মুয়া দেব, মুড়ি দেব/ আর দেব খই’। এরকম মণিরামপুরের প্রতিটা গ্রামের অগণিত লোকছড়া, কাহিনী, ধাঁধা বিলুপ্তির পথে। আরো একটি বিলুপ্ত ছড়া-‘এট্টা কথা/ ব্যাঙের মাথা/ কি ব্যাঙ/ কুলা ব্যাঙ/ কি কুলা/ বাটবিলা/ কি বাট/ গুয়ো কাট/ কি গুয়ো/ ছা গুয়ো/ কি ছাও/ কলা খাও।’
এভাবে সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য লোকজছড়া, যেখানে খুঁজে পাওয়া যায় সমাজচিত্র, ভাষারূপ ও সংস্কৃতি। আবার মণিরামপুর এর কৃষি নির্ভর অঞ্চলের কৃষকদের কৃষি-সংস্কৃতিতে উঠে আসে লোক-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি। প্রধানত কৃষকদের ধান-পাঠ কাটার গানে, ডাক ও খানার বচনে, লাঙ্গলের ফলায় ও ঠেকির আন্দোলনে এবং শ্রমে ও ঘামে ভেসে ওঠে নানান সুরের রূপ মাধুরী। যেমন-মণিরামপুরের অঞ্চলের খনার বচন-‘পটল বুনলে ফাল্গুনে/ ফল বাড়ে দ্বিগুণে/ ফাল্গুনে না বুনলে ওল/ শেষে হয় গন্ডোগোল/ খনা বলে চাষার পো/ শরত শেষে সরষে রো/ সরষে বুনে কলাই মুগ/ বনে বেড়াও চাপড়ে বুক।’ এরকম আরেকটি বচন- ‘ষোল চাষে তুলা/ আট চাষে মূলা/ চার চাষে ধান/ বিনা চাষে ধান।’ এছাড়া এ অঞ্চলে রয়েছে হাজার বছরের লোককাহিনী, লোকাঁথা, ধাঁধা, লোকশিল্প, লোকগীতি, কবিগান, ভাবগান, জারিগান, কীর্ত্তন, যাত্রাপালা ইত্যাদি। আর লোকঐহিত্য হিসেবে ঘোড়া দৌড়, মাল খেলা (কুস্তি), গরুর জুজু (ষাড়ের লড়াই), ঘুড়ির পাল্লা (ঘুড়ি উৎসব), লাঠি খেলা, হাডুডু, দাড়িয়া বান্ধা, বোম, কানামাছি, বাগবন্ধি, ষোল কুটে, মার্বেল, কড়ি, লাটিম, কুৎকুৎ, কাঠি, ইসিনবিসিন, গোল্লাছুট, বউচি, ডাঙ্গুলি প্রভৃতি লোকায়ত খেলা এ অঞ্চলের ঐতিহ্য বহন করে। জাতি হিসেবে মধুপুর, ছিলুমপুরের কুমার পল্লীর নির্মিত মাটির শিল্প, মধুপুরের কামারদের অথবা হোগলাডাঙ্গার তাঁতশিল্প, বাহাদুরপুর, বাগডাঙ্গা, পোড়াডাঙ্গার জেলে পল্লী, কুড়ামারা, বাহাদুরপুর, খানপুরের মুচী (ঋষি) সম্প্রদায়ের শিল্পকর্মের বৈচিত্রতা মণিরামপুরকে সমৃদ্ধ করেছে।
মণিরামপুরের হাজার বছরের ঐতিহ্য হিসেবে ঘোড়া দৌড়ের প্রসঙ্গে দক্ষীন এশিয়ার লোক ঐতিহ্যের ইতিহাসে যে নামগুলো উঠে এসেছে তা অবিশ্বাস্য হলে সত্য। কাশিপুরের বিল, ভরতপুরের ঝিলদার বিল, মাছনার শাহলের বিল, ধুলোর বিল, কাকুড়ের বিল ঘোড়া দৌড়ের মাঠ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। প্রতি মৌসুমে ফসল উঠার পরে সারা দেশ থেকে রেসের ঘোড়া আসে প্রতিযোগীতায় অংশ নেয়ার জন্য। এছাড়া পুড়াডাঙ্গা গ্রামের শ্রী চৈতন্য দীর্ঘকাল যে খেলার আয়োজন করে আসছে তা এখন চৈতন্যের মাল লাগা নামে পরিচিত। দেশ-বিদেশের ছোট-বড় কুস্তিগীর এখানে অংশ নিয়ে পুরস্কার জেতেন। সপ্তাহ ব্যাপী চলে মালের (কুস্তি লড়তে যারা আসেন তাদেরকে মাল বলে) আকর্ষনীয় মহড়া। গরুর জুজু নামে পরিচিত, মূলত ষাড়ের লড়াই, মণিরামপুরের পাঁচবাড়ীয়া, পাঁচকাটিয়া, গোপালপুর, চান্দুয়া, সোমসকাটি, ঢাকুরিয়া, কুড়ামাড়া অঞ্চলের মাঠগুলোতে খুব জাক জমকের সাথে প্রদর্শিত হয়ে থাকে। শত বছরের এ খেলাটি আজও মানুষের কাছে জনপ্রিয়। এছাড়া ঘুড়ির পাল্লা, জয়পুর গ্রামের জারিগানের দল, সোমসকাটি গ্রামের লাঠি খেলার দল এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। আমাদের এই বিলুপ্ত সংস্কৃতি-ঐতিহ্য মণিরামপুরের বাতাসে বাতাসে জানান দিয়ে যায়-আমরা বেঁচে আছি নক্শী কাঁথার উঠোনে, ঘোড়া দৌড়ের উৎসবে অথবা ঘুড়ির রঙিন লেজে।’ দেশের এতটুকু অঞ্চলের লোকজ শিল্প-সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের এতোটা সম্ভারের উজ্জ্বলতা আমাদের গোটা জাতীয় ঐতিহ্যকে চিনিয়ে দেয়। লোকসংস্কৃতি মূলত আত্ম সংস্কৃতির অন্তর্গত। যাকে মানস সংস্কৃতিও বলা যায়। এখানে ঐতিহ্য যেমন যুগের সাথে যুগের সংযোগ তৈরি করে তেমনি লোকায়ত সংস্কৃতি আধুনিকতার সেতুবন্ধনে আরো সুগন্ধময় হয়ে ওঠে। মানুষ-প্রকৃতির প্রকৃত জীবনদর্শন, সমাজদর্শন ও লোকদর্শন সময়ের সুতোয় ঐক্যবদ্ধ হয়ে তুমুল গৌরবে ভাসে। আর তখনই এই অঞ্চলের শিশু-কিশোরের দল চমৎকার ছড়ার বুননের তালে তালে আনন্দে গেয়ে ওঠে-‘সাহেব বিবি চইলা গেল/ কি চমৎকার দেখা গেল/ কোথায় কোথায় জো¹ হইল/ কত লোক মারা গেল/ সাহেব-মেম খানা খাইল/ কি চমৎকার দেখা গেল/ সাপে-বাঘে যুদ্ধ হইল/ কি চমৎকার দেখা গেল।
।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস